মাতৃভাষা প্রাকৃতিক ভাষা, তাই তা বিজ্ঞানময় ভাষা। আর প্রকৃতির মতো খাটি ও উৎকৃষ্ট আর কিছুই নেই। মাতৃভাষা চেতনায় ভরা, ভাব দিয়ে গড়া। আর তাই মাতৃভাষা অনুভূতির চোখে আলো ছড়ায় ও মনের সবকটা জানালা ও দুয়ার খুলে দেয়। মায়ের মুখের মধুর ভাষাই সবার প্রাণের ভাষা।

ভাব প্রকাশ, ভাবের আদান-প্রদান, শিক্ষা ও জ্ঞানসাধনার জন্য চাই ভাষা। আর আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষের মুখের ভাষাবৈচিত্র্যকে সৃষ্টি করেছেন তারই সৃষ্টির নিদর্শন রূপে। মানুষের ভাষাবৈচিত্র্য দ্বারা তিনি জাতিবৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। তাই তো জাতিসত্তার বুকে জাতিসত্তার ভাষা তেমন ‘ঊষার বুকে রাঙা রবি’ যেমন। মাতৃভাষাই সবার মনের আলো ও চোখের আলো।

মাতৃষাষা চিন্তার ভাষা, চেতনার ভাষা, অনুভবের ভাষা, অনুরাগের ভাষা। উচ্ছ্বাসে-আবেগে, আনন্দে-উল্লাসে কোথাও নেই এ ভাষার কমতি। এ ভাষাতেই ঝরে স্বস্তির মুখধ্বনি, এ ভাষাতেই ঝরে কান্নার আর্তি। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মিলন ও বিরহ সংকটে এ ভাষাই সবার জীবন সাথী। ভাষা আছে তাই আছে সুখ, আছে সুর, আছে জীবনের ছন্দ।

হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি মাতৃভাষাতে যত স্বচ্ছ-সুন্দরভাবে তুলে ধরা যায় অন্য ভাষাতে তেমনটা সম্ভব নয়। এর পরও দেখা যায় মানুষ সুখ-দুঃখে, আনন্দ বেদনার সব কথাই বলে না। বলার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। তার মনের কথা মনেই রয়ে যায়, বুকের জ্বালা বুকেই বয়ে বেড়ায়। একটা কথা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারি যে, যে কথা যত বেশি মূল্যবান ও যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বুঝাটাও ঠিক ততখানি গুরুত্বপূর্ণ।

আর আল্লাহ ও তার রাসূলদের কথার মতো অমূল্য ও গুরুত্বপূর্ণ কথা আর কী হতে পারে? তাই নামাজ কিতাবের কথাগুলো অবশ্যই বুঝতে হবে, জানতে হবে। আর বুঝার ব্যাপারে মাতৃভাষা অতুলনীয়। মাতৃভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তার কথা যেমন বলে শেষ করা যায় না, ঠিক তেমনি মাতৃভাষার অধিকারের বঞ্চনার জ্বালা-যন্ত্রণাও জ্বলে জ্বলে শেষ হয় না। এ আগুন জ্বলতেই থাকে অন্তর মাঝে। কেননা বোধগম্য ভাষা ছাড়া শিক্ষা হয় না এবং জ্ঞান সাধনাও সম্ভব নয়।

অথচ শিক্ষা ও জ্ঞানই জীবনকে করে ছন্দময়। অজ্ঞতা জীবনে আনে ছন্দপতন। জীবনকে ছন্দময় করে তুলতে হলে চাই শিক্ষা, চাই জ্ঞান। আর তাই চাই বোধগম্য ভাষা। আর কেবল মাতৃভাষাই প্রাকৃতিক বোধগম্য ভাষা। মানবশিশু পরিবেশ থেকেই তা অর্জন করে। এ ভাষা বিশেষভাবে কাউকে শিক্ষা দিতে হয় না। তাই তো আল্লাহর কাছে বান্দাদের মাতৃভাষা বা মুখের ভাষাই অত্যন্ত প্রিয় ও ছন্দনীয়। আল্লাহ কুরআনের সূরা ইবরাহিমের ৪নং আয়াতে জাতিসত্তার ভাষা বা মাতৃভাষা চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ আয়াতটি কুরআনের বুকে মধুপূর্ণিমার চাঁদের মতোই। তা কিয়ামত পর্যন্ত মাতৃভাষা চেতনার আলো ছড়িয়ে যাবে।

ওই মধু চাঁদ আর তারি জোছনা আমার চেতনায় সাড়া জাগায়, আমাকে আবেগে জড়ায়, আমার অনুভূতির চোখে আলো ছড়ায়, আমায় অনুরাগে মাতায়, আমার দুচোখে স্বপ্ন ছড়ায়, আমার মন রাঙায় ও ঘুম ভাঙায়। আমার ধর্মীয় অনুভূতিকে চাঙ্গা করে তোলে। আমি বাঙালি, বাংলা আমার মায়ের ভাষা। আমার মায়ের মুখের মধুর ভাষা আমার ভাইয়ের বুকের রক্তে রাঙা। তাই আমি বাংলায় কথা বলি, বাংলার কথা বলি।

বাংলা আমার হৃদয়বীণার তারে তারে বড়ই সুমধুর সুরের ঝংকার তোলে, আমি ঝংকৃত হই তারি দোলায়। ভাষার বিষয়ে সূরা ইবরাহিমের ৪নং আয়াতই হচ্ছে আমাদের পথের আলো। এ আলোতেই আমরা পথ খুঁজে পাব ইনশাআল্লাহ।

মাতৃভাষার কুরআন পাঠ আমার অনুভূতির চোখে যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে আর সূরা ইবরাহিমের ৪নং আয়াত আমার অন্তরে যে ভাষাচেতনার (মাতৃভাষা চেতনা) উন্মেষ ঘটিয়েছে ওই চেতনার আলোটুকুই আমি সঞ্চয়ে রেখেছি। আমি প্রদ্বীপের মতো জ্বলে জ্বলে এ চেতনার আলোটুকু ছড়িয়ে যেতে চাই। মাতৃভাষা মধ্য দিনের সূর্যালোকের মতোই সব জাতির অনুভূতির চোখে আলো ছড়িয়ে চলেছে। মাতৃভাষার কুরআন পড়তে পড়তে মাতৃভাষার যে অপূর্ব রূপ ও রং আমি দেখেছি ওই রং ও রূপের মাধুরী ছড়িয়ে সবার মন রাঙাতে চাইছি।

নামাজ-কুরআন-হাদিস বোধগম্য ভাষায় পাঠ, শ্রবণ ছাড়া কখনোই তা যথার্থ কল্যাণ ও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। বোধগম্যহীন ভাষায় যতই পুনরাবৃত্তি করা হোক না কেন কখনোই তার মর্মমূলের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না এবং যাবেও না। এতে কুরআনের প্রকৃত সৌন্দর্য ও মাধুর্য ফুটে ওঠে না, তার প্রকৃত রং-রূপও প্রকাশ পায় না। কেননা বোধগম্য ভাষা ছাড়া কোনো কথার অর্থ-মর্ম বোঝা যায় না।

কোনো কথা বোঝা ছাড়া তা কখনো শিক্ষা কিংবা জ্ঞানে পরিণত হয় না। এ কারণে কুরআনে ভাষা প্রসঙ্গে বারবার বলা হয়েছে যেন বুঝতে পার, বুঝাতে পার, বুঝতে পারে, বুঝাতে পারে। বোধগম্যহীন ভাষা অমানিশার অন্ধকারের মতো। এ আঁধারের কাছে শূন্যতাই খুঁজে পাব। বোধগম্যহীন ভাষা অমারাত্রির মতো অন্ধকারের বিস্তার ঘটায়। মায়ের বুকে সন্তানের লাশ যেমন কষ্টকর ও বেদনাদায়ক, উপলব্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে বোধগম্যহীন ভাষা ও শিক্ষার লাশ তেমন কষ্টকর ও বেদনাদায়ক,

কিন্তু আমরা সিংহভাগ মানুষই আলো-আঁধারের পার্থক্য বুঝি না। কেননা শৈশবেই আমাদের ধর্মের চোখ করে দেওয়া হয় অন্ধ। তাই আমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত আলো ভেবে আঁধারকে বুকে আঁকড়ে রাখি। জীবন নদীর ঘাটে ঘাটে যেখানেই নোঙর ফেলি না কেন শূন্যতা ছাড়া কিছুই খুঁজে পাই না। অজ্ঞতার অন্ধকারেই বন্দি হয়ে থাকি কুরআন পড়েও।

কুরআন বলে পৃথিবীর সব জাতিতেই আল্লাহ নবি-রাসূল প্রেরণ করেছেন। সবাইকে জাতিসত্তার ভাষা দিয়ে পাঠিয়েছেন। আর পৃথিবীর বাস্তবতায় দেখা যায় সব রাসূলের কাছে নিজ নিজ জাতিসত্তার ভাষায় কিতাব, সহিফা দিয়েছিল যেন জাতিকে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে। এর থেকে অকাট্যভাবেই প্রমাণ হয়ে যায় যে, নবি-রাসূলদের মুখের ভাষানীতির ধারার ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল মাতৃষাভানীতির ইতিহাস-ঐতিহ্য।

মাতৃভাষা নীতির ধারাই ভাষানীতির মূলধারা ও পগতিশীল ধারা। কুরআন আমাদের মুক্তির পথ দেখায়। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, আন্দোলন ও লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়। কুরআনের শিক্ষা আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত, আলোড়িত ও আলোকিত করে। ধর্মীয় অনুভূতিকে চাঙা করে। আমাদের দুচোখে স্বপ্ন ছড়ায় বোধগম্য ভাষার ইবাদতে যেমন সুখানুভূতি অনুভূত হয় অবোধ ভাষায় কখনোই তা সম্ভব নয়। কুরআনের শিক্ষা আমাদের চিন্তার খোরাখ, জীবনের খোরাক, কলমের খোরাক জোগায়। আল্লাহ স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন ভাষার কাজ কথাকে বোঝান।

আর সহজে পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য তিনি সূরা ইবরাহিমের ৪নং আয়াতে মাতৃষাভার সরল পথটাই দেখিয়ে দিয়েছেন। যেন তার শিক্ষা ও জ্ঞানালোয় বান্দাদের হৃদয় উদ্ভাসিত হয়। মাতৃভাষার পথ নিশ্চিত শিক্ষার পথ ও জ্ঞানের পথ। তাই এ পথ সর্বোত্তম পথ। ইসলাম প্রগতিশীল ধর্ম। অনারব মুসলমানদের ফিরে আসতে হবে ভাষানীতির মূলধারা ও প্রগতিশীল ধারা মাতৃভাষানীতির ধারাতে।

মাতৃভাষাই দ্বীন ইসলামের দাবি। কেননা প্রত্যেক নাবি-রাসূলের ধর্ম ছিল এক ইসলাম। যেহেতু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। ইসলামের মর্মকথার বা মর্মবাণী এক ও অভিন্ন। সব আসমানি কিতাবই এক আল্লাহর বাণী বা কথা। তবে মানুষের ভাষার ভিন্নতার কারণে তারই এক এক কিতাব এক এক জাতির মাতৃভাষার বা জাতিসত্তার ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। সব ভাষাই ইসলামি ভাষা।

 

কলমকথা/বিসুলতানা